মাশরুম
মাশরুম

 মাশরুম

ব্যাঙের ছাতাকেই আমরা মাশরুম হিসেবে চিনে থাকি যা প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এসব মাশরুমের সব প্রজাতি খাওয়ার উপযুক্ত না। কিছু কিছু প্রজাতির মাশরুম বেশ বিষাক্ত হয়ে থাকে, যা মানুষের মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

দিন বদলেছে। সময় পাল্টেছে। মানুষ এখন আর প্রকৃতির দয়ার আশায় বসে থাকে না। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে মাশরুম উৎপাদন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে মানুষ। তাই এখন ঘরে বসেই বছরের যেকোন সময় মাশরুম উৎপাদন করে খাওয়া যাচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে লাভবান হচ্ছে অনেকেই। 

মাশরুমের উপকারিতা

মাশরুম খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি বেশ পুষ্টি ও ঔষধিগুণসম্পন্ন। এর মধ্যে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন, অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যামাইনো এসিড। মাশরুম প্রোটিনের ভালো একটা উৎস হওয়ায় মাশরুমকে সবজি মাংসও বলা হয়ে থাকে। নিম্নে মাশরুমের উপকারিতাসমূহ আলোচনা করা হল-
১) মাশরুমে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম ও লৌহ জাতীয় পদার্থ থাকায় মাশরুম দেহের ক্ষয়পূরণ ও হাড় গঠনে ভূমিকা রাখে।
২) মাশরুমে বিদ্যমান লৌহ রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩) মাশরুম কোলেস্টেরেলমুক্ত ও কম চর্বিযুক্ত হওয়ায় হৃদরোগীদের জন্য খুবই উপকারি।
৪) মাশরুমে চিনি বা শর্করার পরিমাণ কম থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি উপযুক্ত খাবার।
৫) মাশরুমে বিদ্যমান আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।

এছাড়া মাশরুম দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও হজম শক্তি বাড়াতে সাহয্য করে। নিয়মিত মাশরুম খেলে শারিরীক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। 

মাশরুম চাষের সুবিধা

১) মাশরুম চাষের সুবিধা হলো - এতে পুঁজি কম লাগে। মাত্র ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় মাশরুম চাষ শুরু করা সম্ভব।
২) মাশরুম চাষের দ্বিতীয় গুরত্বপূর্ণ সুবিধা হলো - আবাদি জমির প্রয়োজন হয়না। খুব অল্প জায়গায়, বাড়ির আশপাশের খালি জায়গায়, বা বাড়ির ভেতরেও মাশরুম চাষ করা সম্ভব।
৩) মাশরুম চাষের কাঁচামাল যেমন- খড়, ভুসি, কাঠের গুড়া খুব সহজলভ্য।
৪) কম সময়ে দ্রুত ফলন পাওয়া যায় যা অন্য কোন ফসল চাষে পাওয়া যায় না। 
৫) বেকার যুবক থেকে শুরু করে গৃহিণী অর্থাৎ সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ মাশরুম চাষ করতে পারে।
৬) এদেশের আবহাওয়া মাশরুম চাষের জন্য খুবই উপযোগী।


চাষযোগ্য মাশরুম জাত

পৃথিবীতে ৮-১০ প্রজাতির মাশরুম বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে বাংলাদেশে নিম্নোক্ত প্রজাতিগুলো চাষযোগ্য- 
১) Oyster Mushroom - ঝিনুক মাশরুম
২) Milky Mushroom - দুধ মাশরুম
৩) Button Mushroom - বাটন মাশরুম
৪) Straw Mushroom - খড় মাশরুম
৫) Ear Mushroom - কান মাশরুম
৬) Shitake Mushroom - শিতাকে মাশরুম

বাংলাদেশে ৪ প্রজাতির মাশরুম চাষ করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো-

১) অয়েস্টার মাশরুম: অয়েস্টার সারাবছর চাষ করা যায় বলে খুবই জনপ্রিয় এই মাশরুম। বাংলাদেশে এই প্রজাতির মাশরুম সবচেয়ে বেশি চাষ করা হচ্ছে। সারাবছর চাষ করা গেলেও বর্ষাকাল ও শীতকালে এর ফলন বেশি পাওয়া যায়।

২) বাটন মাশরুম: শীতের সময় এই মাশরুম চাষ করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি বাটন মাশরুম চাষ করার উপযুক্ত সময়।

৩) স্ট্র মাশরুম: গ্রীষ্মকাল অর্থাৎ বাংলাদেশে মার্চ থেক সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্ট্র মাশরুম চাষের উপযুক্ত সময়। এই মাশরুম চাষের জন্য শিমুল তুলা, ধানের খড়, চালের কুড়া ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

৪) ইয়ার মাশরুম: এই মাশরুম যদিও সারাবছর চাষ করা যায়, কিন্তু বর্ষাকালে এর ফলন বেশি পাওয়া যায়। প্রাকৃতিকভাবে বর্ষাকালে আমগাছে ইয়ার মাশরুম জন্মাতে দেখা যায়। 

মাশরুম চাষ পদ্ধতি

আমরা অয়েস্টার মাশরুম চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করব।

মাশরুম চাষের উপকরণ

মাশরুম চাষের প্রয়োজনীয় উপকরণের মধ্যে রয়েছে মাশরুম বীজ বা স্পন, ধানের খড়, পাতলা পলিথিন ব্যাগ, রাবার, বাঁশ, ব্লেড বা ছুরি, হ্যান্ড স্প্রেয়ার, উষ্ণতা ও আর্দ্রতা মাপার হাইগ্রোমিটার, চুন ও জীবাণুনাশক, বড় পাত্র বা ড্রাম ইত্যাদি।

মাশরুম চাষের ঘর কেমন হতে হবে

মাশরুম চাষের জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে ঘর নির্মাণ করতে হবে। খড় ও বাঁশ ব্যবহার করে এই ঘর তৈরি করা যাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে ঘরের ভেতর সরাসরি সূর্যের আলো যাতে প্রবেশ করতে না পারে এবং প্রয়োজনীয় বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকে।

মাশরুম চাষের ধাপ

১) মাশরুম বীজ বা স্পন প্যাকেট সংগ্রহ: সাধারণত মাশরুম বীজ উৎপাদকেরা ১ কেজি বা ২৫০ গ্রামের ছোট প্যাকেটের মাশরুম বীজ বা স্পন প্যাকেট উৎপাদন করে থাকে। এক্ষেত্রে জায়গাভেদে ছোট প্যাকেটগুলো ২০-৩০ টাকা হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাশরুম বীজ বা স্পন প্যাকেট সংগ্রহ করতে হবে। রেডিমেড পাওয়া যায় আবার অগ্রিম অর্ডার করেও রাখা যায়। অর্ডার দিলে এক থেক দেড় মাসের সময় নিয়ে থাকেন উৎপাদকেরা। আর একটা স্পন প্যাকেট দিয়ে মাঝারি সাইজের পলিথিন হলে দুইটা এবং বড় সাইজের পলিথিন হলে একটা বেড বা সিলিন্ডার তৈরি করা যায়।

২) খড় সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ: প্রতিটা স্পন প্যাকেটের জন্য আপনাকে ২-৩ কেজি পরিমাণের খড় সংগ্রহ করতে হবে। খড় কাটার মেশিন দিয়ে কিংবা ম্যানুয়ালি দা দিয়ে ১ ইঞ্চি করে খড়গুলো টুকরো করে নিতে হবে। এতে মাশরুম বেড বা সিলিন্ডার তৈরি সহজ হয়। অভিজ্ঞ হলে খড় না কেটেও প্যাকেটিং করা যায়। 

৩) খড় বিশুদ্ধকরণ: মাশরুম চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল খড় বিশুদ্ধকরণ। খড় বিশুদ্ধ না হলে নানা ধরণের ফাঙ্গাসের আক্রমণ হয়ে থাকে যা মাশরুম উৎপাদনকে ব্যাহত করে। তাই মাশরুম চাষের জন্য ভালোভাবে খড় বিশুদ্ধ করতে হবে। দুইভাবেই খড় বিশুদ্ধ করা যায়। একটা পদ্ধতি হচ্ছে ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সিদ্ধ করে। আরেকটা পদ্ধতি হচ্ছে চুন+জীবাণুনাশক(ব্লিচিং পাউডার) যুক্ত পানিতে ১২-২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে। এরপর খড়গুলোকে রোদে শুকাতে দিতে হবে। খড়গুলো পুরোপুরি না শুকিয়ে হালকা ভেজা অবস্থায় সংগ্রহ করতে হবে।
খড় পরিশোধনের এই ভিডিওটি দেখে নিন-



৪) মাশরুম বেড বা সিলিন্ডার তৈরি: ২৫০ গ্রামের স্পন প্যাকেটকে সমান দুইভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগকে আবার সমান তিনভাগে ভাগ করে গুড়া করে নিতে হবে। এবার মাঝারি সাইজের দুইটা পলিথিন নিয়ে খড়+বীজ+খড়+বীজ+খড়+বীজ+খড় অর্থাৎ ৪ স্তরের খড় ও ৩ স্তরের বীজ দিয়ে সাজাতে হবে। বড় সাইজের পলিথিন হলে একটা স্পন প্যাকেট দিয়ে একটাই সিলিন্ডার তৈরি করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্পনকে সমান ৪ ভাগ করে ৫ স্তরের খড় ও ৪ স্তরের স্পন দিয়ে সিলিন্ডার সাজাতে হবে। 
মাশরুম সিলিন্ডার তৈরির ভিডিওটি দেখে নিন-



৫) সিলিন্ডার বাঁধা ও ছিদ্রকরণ: মাশরুম চাষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হল সিলিন্ডার সঠিকভাবে বাঁধা। এজন্য সিলিন্ডার বা পলিথিনের সমস্ত বাতাস বের করে দিয়ে খুব শক্ত করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধতে হবে। তারপর চারপাশে ১০-১২ টি ছিদ্র করে দিতে হবে।

৬) জল স্প্রে: মাশরুম প্যাকেট বা সিলিন্ডারগুলো ১০-১৫ দিনের মধ্যে পুরোটাই সাদা হয়ে আসবে অর্থাৎ বীজে পরিণত হবে। এরপর ছিদ্রগুলো দিয়ে মাশরুমের কুঁড়ি বা পিনহেডগুলো বেরিয়ে আসবে। তখন থেকেই পিনহেডগুলোতে জল স্প্রে করতে হবে প্রতিদিন তিনবার করে। এতে পিনহেডগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ২-৩ দিনেই খাওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে।